স্বাধীনতার ৫১ বছরে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে। সীমিত সম্পদ নিয়ে কমপক্ষে ২০ খাতে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে। এসব খাতে বাংলাদেশ আছে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়।
বাংলাদেশ বদলে গেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই।
নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আর মানবিক মর্যাদায় বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে পুরো বিশ্বকেই। ১০ লাখ নির্যাতিত মানুষকে একসঙ্গে আশ্রয় দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। এসব জমিতে গড়ে ফসল ফলত একটি। ফলে খাদ্য চাহিদা মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশি অনুদান ও খাদ্য সহায়তার ওপর দেশকে নির্ভর করতে হতো। ৫১ বছর পর আবাদযোগ্য ৬০ শতাংশ জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও আগের চেয়ে সোয়া দুই গুণ জনসংখ্যার চাপ নিয়েও নিজস্ব উৎপাদন দিয়ে পুরো খাদ্য চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে বাংলাদেশ। কৃষির এই বিপ্লবের স্বীকৃতি এসেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে। সংস্থাটির বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ১০ দেশের কাতারে বাংলাদেশকে গণ্য করা হয়েছে।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই হয় এ দেশে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তবে পাট রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম। ছাগল উৎপাদনেও অবস্থান চতুর্থ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। চা উৎপাদনে অবস্থান নবমে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আম উৎপাদনে অষ্টম। কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। পেয়ারা উৎপাদনে বর্তমানে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অষ্টম। সার্বিক ফল উৎপাদনে রয়েছে দশম অবস্থানে। গবাদিপশু পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক (গার্মেন্ট) শিল্প। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক পাওয়া যায় না। গার্মেন্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। পোশাকের পাশাপাশি বাংলাদেশের ওষুধ এখন ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৮০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশীয় ওষুধশিল্প কারখানাগুলো দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ ওষুধ জোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ জীবন বাঁচাচ্ছে বিশ্বের আনাচে কানাচের মানুষকে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত করেছে। বাংলাদেশি তরুণ-যুবারাই তৈরি করছে বিভিন্ন দেশের গর্বের কাঠামো, ঘুরিয়ে দিচ্ছে তাদের অর্থনীতির চাকা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অগ্রগণ্য। যুদ্ধবিগ্রহের বিশ্বকে ব্লু হেলমেট মাথায় দিয়ে বুক আগলিয়ে রক্ষা করছে
বাংলাদেশের দুর্বার সেনারাই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রথম।
রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশের তালিকাতেও বাংলাদেশ আছে শীর্ষ দশে। বর্তমানে প্রায় সোয়া কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ, যা শতকরা হারে বিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ। এই বদৌলতে বাংলাদেশ এ খাতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে কটাক্ষ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন মার্কিন মদদপুষ্ট মোড়ল বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করছে বাংলাদেশ। কারণ দিন বদলে গেছে। বাংলাদেশ এখন তার সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে নিজস্ব অর্থায়নে। স্বাধীনতার মাত্র ৫১ বছরে এই পরিবর্তন বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কাছে পরাজিত হয় একসময়ের সমৃদ্ধ দেশ পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানের চেয়ে এখন প্রায় সবক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে ভারত-চীনের থেকেও এগিয়ে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অথচ ভারত-পাকিস্তানের অনেক পরে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। কিন্তু স্বাস্থ্য-শিক্ষার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জিডিপি ও মাথাপিছু জিডিপি পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। গ্রস সেভিংস জিডিপিতে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের চেয়েই এগিয়ে বাংলাদেশ। শিশুমৃত্যুর হারের ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শীর্ষে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা
নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানের তুলনায় অনেক উচ্চতায় বাংলাদেশ। জন্মহার নিয়ন্ত্রণেও প্রতিবেশীদের ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও ভারত পাকিস্তান দুই দেশের তুলনায় এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
মানবিক মর্যাদায় ছাড়িয়ে গেছে পুরো বিশ্বকেই : মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে পুরো বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের এই ঢল নামলে সীমান্ত খুলে দেয় বাংলাদেশ। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে এক নতুন মানবিক পরিচয় পায় বাংলাদেশ। বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের মানবিকতার প্রশংসা আসছে এখনো। আজকের বিশ্বে এত বিপুল সংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও জায়গা পেত কি-না এ নিয়ে সংশয় আছে সবারই।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন